কবি – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সেদিন শারদদিবা-অবসান, শ্রীমতী নামে সে দাসী
পুণ্যশীতল সলিলে নাহিয়া
পুষ্পপ্রদীপ থালায় বাহিয়া
রাজমহিষীর চরণে চাহিয়া নীরবে দাঁড়ালাে আসি।
শিহরি সভয়ে মহিষী কহিলা, এ কথা নাহি কি মনে,
অজাতশত্রু করেছে রটনা
স্তূপে যে করিবে অর্ঘ্যরচনা
শূলের উপরে মরিবে সে জনা অথবা নির্বাসনে!
সেথা হতে ফিরি গেল চলি ধীরে বধূ অমিতার ঘরে।
সমুখে রাখিয়া স্বর্ণমুকুর
বাঁধিতেছিল সে দীর্ঘ চিকুর,
আঁকিতেছিল সে যত্নে সিঁদুর সীমন্তসীমা-পরে।
শ্ৰীমতীরে হেরি বাঁকি গেল রেখা, কাপি গেল তার হাত
কহিল, অবােধ, কী সাহসবলে
এনেছিস পূজা! এখনি যা চলে
কে কোথা দেখিবে, ঘটিবে তা হলে বিষম বিপদ্পাত।
অক্তরবির রশিআভায় খােলা জানালার ধারে
কুমারী শুক্লা বসি একাকিনী
পড়িতে নিরত কাব্যাকাহিনী,
চমকি উঠিল শুনি কিছ্কিণী-চাহিয়া দেখিল দ্বারে।
শ্ৰীমতীরে হেবি পুঁথি রাখি ভূমে ফ্রুতপদে গেল কাছে।
কহে সাবধানে তার কানে কানে,
রাজার আদেশ আজি কে না জানে-
এমন করে কি মরণের পানে ছুটিয়া চলিতে আছে!
দ্বার হতে দ্বারে ফিরিল শ্রীমতী লইয়া অর্ঘ্াখালি।
হে পুরবাসিনী সবে ডাকি কয়,
হয়েছে এভুর পূজার সময়।
শুনি ঘবে ঘরে কেহ পায় ভয়, কেহ দেয় তারে গালি।
দিবসের শেষ আলােক মিলালাে নগরসৌধ-পরে।
পথ জনহীন আঁধারে বিলীন,
কলকোলাহল হয়ে এল ক্ষীণ,
আরতিঘণ্টা ধবনিল প্রাচীন রাজদেবালয়-ঘরে।
শারদনিশির স্বচ্ছ তিমিরে তারা অগণ্য জবলে
সিংহদুয়ারে বাজিল বিষাণ,
বন্দীরা ধরে সন্ধ্যার তান,
মন্ত্রণাসভা হল সমাধান দ্বারী ফুকারিয়া বলে।
এমন সময়ে হােরিলা চমকি প্রাসাদে প্রহরী যত
রাজার বিজন কানন-মাঝারে
ভগপদমূলে গহন আঁধারে
জুলিতেছে কেন যেন সারে সারে প্রদীপমালার মতাে?
মুক্তকৃপাণে পুররক্ষক তখনি ছুটিয়া আসি
শুধালাে, কে তুই ওরে দুর্মতি,
মরিবার তরে কবিস আরতি?
মধুর কষ্ঠে শুনিল, শ্রীমতী, আমি বুদ্ধের দাসী।
সেদিন শুভ্র পাযাণফলকে পড়িল রক্তলিখা।
সেদিন শারদস্বচ্ছনিশীখে
প্রাসাদকাননে নীরবে নিভৃতে
ভূপপদমূলে নিবিল চকিতে শেষ আরতির শিখা।