বন্দী বীর

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

পঞ্চনদীর তীরে
বেণী পাকাইয়া শিরে
দেখিতে দেখিতে গুরুর মন্ত্রে জাগিয়া উঠেছে শিখ
নির্মম নির্ভীক।
হাজার কণ্ঠে গুরুজীর জয়’ ধ্বনিয়া তুলেছে দিক।
নূতন জাগিয়া শিখ
নূতন উষার সূর্যের পানে চাহিল নির্নিমিখ॥


অলখ নিরঞ্জন
মহারব উঠে বন্ধন টুটে করে ভয়ভঞ্জন।
বক্ষের পাশে ঘন উল্লাসে অসি বাজে ঝঞ্চন।
পঞ্জাব আজি গরজি উঠিল, অলখ নিরঞ্জন!

এসেছে সে এক দিন
লক্ষ পরানে শঙ্কা না জানে, না রাখে কাহারাে ঋণ
জীবন মৃত্যু পায়ের ভূত্য, চিত্ত ভাবনাইীন।
পঞ্চনদীর ঘিরি দশ তীর এসেছে সে এক দিন।।

দিল্লিপ্রাসাদকূটে
হােথা বার বার বাদশাজাদার তন্দ্রা যেতেছে ছুটে।
কাদের কণ্ঠে গগন মু্থে, নিবিড় নিশীথ টুটে-
কাদের মশালে আকাশের ভালে আগুন উঠেছে ফুটে?

পঞ্চনদীর তীরে
ভক্তদেহের রক্তলহরী মুক্ত হইল কি রে।
লক্ষ বক্ষ চিরে
ঝাকে ঝাকে প্রাণ পক্ষীসমান ছুটে যেন নিজ নীড়ে।
বীরগণ জননীরে
রক্ততিলক ললাটে পরালাে পঞ্চনদীর তীরে।

মােগল-শিখের রণে
মরণ-আলিঙ্গনে
কণ্ঠ পাকড়ি ধরিল আঁকড়ি দুইজনা দুইজনে-
দংশনক্ষত শ্যেনবিহঙ্গ যুঝে ভুজঙ্গ-সনে।
সেদিন কঠিন রণে
জয় গুরুজীর’ হাঁকে শিখবীর সুগভীর নিঃস্বনে।
মত্ত মােগল রক্তপাগল দীন দীন গরজনে।

গুরুদাসপুর গড়ে
বন্দা যখন বন্দী হইল তুরানি সেনার করে,
সিংহের মতাে শৃঙ্খলগত বাঁধি লয়ে গেল ধরে।
দিল্লিনগর-পরে।
বন্দা সমরে বন্দী হইল গুরুদাসপুর গড়ে।

সম্মুখে চলে মােগল সৈন্য উড়ায়ে পথের ধূলি
ছিন্ন শিখের মুণ্ড লইয়া বর্শাফলকে তুলি
শিখ সাত শত চলে পশ্চাতে, বাজে শৃঙ্খলগুলি।
রাজপথ-পরে লােক নাহি ধরে, বাতায়ন যায় খুলি।
শিখ গরজয় গুরুজীর জয়’ পরানের ভয় ভুলি।
মােগলে ও শিখে উড়ালাে আজিকে দিল্ন্লিপথের ধূলি।

পড়ি গেল রলাড়াকড়ি
আগে কেবা প্রাণ করিবেক দান, তারি লাগি তাড়াতাড়ি।
দিন গেলে প্রাতে ঘাতকের হাতে বন্দীরা সারি সারি
জয় গুরুজীর কহি শত বীর শত শির দেয় ডারি।

সপ্তাহকালে সাত শত প্রাণ নিঃশেষ হয়ে গেলে
বন্দার কোলে কাজি দিল তুলি বন্দার এক ছেলে
কহিল, ইহারে বধিতে হইবে নিজ হাতে অবহেলে।
দিল তার কোলে ফেলে
কিশাের কুমার, বাঁধা বাহু তার, বন্দার এক ছেলে।

কিছু না কহিল বাণী,
বন্দা সুধীরে ছােটো ছেলেটিরে লইল বক্ষে টানি।
ক্ষণকালতরে মাথার উপরে রাখে দক্ষিণপাণি,
শুধু একবার চুম্বিল তার রাঙা উষ্ণীষখানি।
তার পরে ধীরে কটিবাস হতে ছুরিকা খসায়ে আনি
বালকের মুখ চাহি
গুরুজীর জয় কানে কানে কয়, রে পুত্র, ভয় নাহি।
নবীন বদনে অভয়কিরণ জ্বলি উঠে উৎসাহি-
কিশােরকণ্ঠে কাপে সভাতল, বালক উঠিল গাহি
গুরুজীর জয়, কিছু নাহি ভয় বন্দার মুখ চাহি।
বন্দা তখন বামবাহুপাশ জড়াইল তার গলে,
দক্ষিণকরে ছেলের বক্ষে
গুরুজীর জয়’ কহিয়া বালক লুটালাে ধরণীতলে।
ছুরী বসাইল বলে

সভা হল নিস্তব্ধ।
বন্দার দেহ ছিড়িল ঘাতক সাঁড়াশি করিয়া দগ্ধ।
স্থির হয়ে বীর মরিল, না করি, একটি কাতর শব্দ।
দর্শকজন মুদিল নয়ন, সভা হল নিস্তব্ধ।।


এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান