Rahur Prem Bangla Kobita || রাহুর প্রেম কবিতা Rabindranath Tagore


কবিতা  -রাহুর প্রেম

     কবি- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (Rabindranath Tagore)


শুনেছি আমারে ভালােই লাগে না, নাই বা লাগিল তাের।
কঠিন বাঁধনে চরণ বেড়িয়া
চিরকাল তােরে রব আঁকড়িয়া
লােহার শিকল-ডাের।
তুই তাে আমার বন্দী অভাগী, বাঁধিয়াছি কারাগারে,
প্রাণের বাঁধন দিয়েছি প্রাণেতে, দেখি কে খুলিতে পারে।
জগৎ-মাঝারে যেথায় বেড়াবি,
যেথায় বসিবি, যেথায় দাঁড়াবি,
বসন্তে শীতে দিবসে নিশীথে
সাথে সাথে তাের থাকিবে বাজিতে
এ পাষাণপ্রাণ চিরশৃঙ্খল চরণ জড়ায়ে ধরে
একবার তােরে দেখেছি যখন কেমনে এড়াবি মােরে?
চাও নাহি চাও, ডাকো নাই ডাকো,
কাছেতে আমার থাকো নাই থাকো,
যাব সাথে সাথে, রব পায় পায়, রব গায় গায় মিশি—
এ বিষাদ ঘাের, এ আঁধার মুখ, এ অশ্রুজল, এই ভাঙা বুক,
ভাঙা বাদ্যের মতন বাজিবে সাথে সাথে দিবানিশি ৷৷


নিত্যকালের সঙ্গী আমি যে, আমি যে রে তাের ছায়া
কিবা সে রােদনে কিবা সে হাসিতে
দেখিতে পাইবি কখনাে পাশেতে
কভু সম্মুখে কভু পশ্চাতে আমার আঁধার কায়া।
গভীর নিশীথে একাকী যখন বসিয়া মলিনপ্রাণে
চমকি উঠিয়া দেখিবি তরাসে
আমিও রয়েছি বসে তাের পাশে
চেয়ে তাের মুখপানে। যে দিকেই তুই ফিরাবি বয়ান
সেই দিকে আমি ফিরাব নয়ান,
যে দিকে চাহিবি আকাশে আমার আঁধার মুরতি আঁকা-
সকলি পড়িবে আমার আড়ালে, জগৎ পড়িবে ঢাকা।
দুঃস্বপনের মতাে চিরকাল তােমারে রহিব ঘিরে,
দিবসরজনী এ মুখ দেখিব তােমার নয়ননীরে।
চিরভিক্ষার মতন দাঁড়ায়ে রব সম্মুখে তাের।
‘দাও দাও’ বলে কেবলি ডাকিব , ফেলিব নয়নলাের।
কেবলি সাধিব, কেবলি কাদিব, কেবলি ফেলিব শ্বাস,
কানের কাছেতে প্রাণের কাছেতে করিব রে হাহুতাশ।
মাের এক নাম কেবলি বসিয়া জপিব কানেতে তব,
কাটার মতন দিবসরজনী পায়েতে বিধিয়ে রব।
গত জনমের অভিশাপ-সম রব আমি কাছে কাছে,
ভাবী জনমের অদৃষ্ট-হেন বেড়াইব পাছে পাছে৷৷


যেন রে অকূল সাগর-মাঝারে ডুবেছে জগৎ-তরী,
তারি মাঝে শুধু মােরা দুটি প্রাণী
রয়েছি জড়ায়ে তাের বাহুখানি,
যুঝিস ছাড়াতে, ছাড়িব না তবু মহাসমুদ্র-‘পরি।
পলে পলে তাের দেহ হয় ক্ষীণ,
পলে পলে তাের বাহু বলহীন-
দোঁহে অনন্তে ডুবি নিশিদিন, তবু আছি তােরে ধরি।|


রােগের মতন বাঁধিব তােমারে দারুণ আলিঙ্গনে
মাের যাতনায় হইবি অধীর,
আমারি অনলে দহিবে শরীর,
অবিরাম শুধু আমি ছাড়া আর কিছু না রহিবে মনে।|


ঘুমাবি যখন স্বপন দেখিবি, কেবল দেখিবি মােরে—
এই অনিমেষ তৃষাতুর আঁখি চাহিয়া দেখিছে তােরে।
নিশীথে বসিয়া থেকে থেকে তুই শুনিবি আঁধারঘােরে
কোথা হতে এক ঘাের উন্মাদ ডাকে তাের নাম ধরে।
নিরজন পথে চলিতে চলিতে সহসা সভয় গণি।
সাঁঝের আঁধারে শুনিতে পাইবি আমার হাসির ধ্বনি।|


হেরাে তমােঘন মরুময়ী নিশা—
আমার পরান হারায়েছে দিশা,
অনন্ত ক্ষুধা অনন্ত তৃষা করিতেছে হাহাকার। আজিকে যখন পেয়েছি রে তােরে
এ চিরযামিনী ছাড়িব কী করে,
এ ঘাের পিপাসা যুগযুগান্তে মিটিৰে কি কভু আর!
বুকের ভিতরে ছুরির মতন,
মনের মাঝারে বিষের মতন,
রােগের মতন, শােকের মতন রব আমি অনিবার।|


জীবনের পিছে মরণ দাঁড়ায়ে, আশার পিছনে ভয়-
ডাকিনীর মতাে রজনী ভ্ৰমিছে
চিরদিন ধরে দিবসের পিছে
সমস্ত ধরাময়।
যেথায় আলােক সেইখানে ছায়া এই তাে নিয়ম ভবে-
ও রূপের কাছে চিরদিন তাই এ ক্ষুধা জাগিয়া রবে।|

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান